নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩২ হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তাঁদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যে হতাহতের এ চিত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার রাত পৌনে একটার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল বেলা দুইটার পর আইএসপিআর জানায়, দুপুর ১২টা পর্যন্ত তারা ৩১ জনের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে। এ সময় পর্যন্ত তারা আহতের সংখ্যা জানিয়েছে অন্তত ১৬৫ জন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গুরুতর আহত অন্তত ৪০ জন।
নিহতের সংখ্যা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, আইএসপিআর ও বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। গত সোমবার রাত দুইটার দিকে আইএসপিআর ২০ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছিল। তবে ওই রাতে প্রথম আলো জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকের মাধ্যমে আরও দুজন নিহত হওয়ার তথ্য পায়। তাঁদের একজন রাত সাড়ে ১০টার দিকে মারা যান। আরেকজন মারা গেছেন রাত ১২টার দিকে।
গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত আইএসপিআর ৩১ জনের মৃত্যুর খবর জানায়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হালনাগাদ একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে ২৭ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি শিশু। এতে আরও বলা হয়, ২০টি মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ছয়টি মরদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে রয়েছে। তাঁদের পরিচয় শনাক্ত হয়নি।
এ ছাড়া নিহত পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের মরদেহ রাজশাহীতে দাফন করা হয়েছে।
বেলা তিনটার পর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বার্ন ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের বলেন, তখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ২৯। তবে গতকাল রাত সাড়ে ১২টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি।
গতকাল রাত পৌনে একটার দিকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান প্রথম আলোকে জানান, আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাফি (৯) নামের এক শিশু রাত সোয়া ১২টায় মারা গেছে। তার শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।
আইএসপিআরের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যের তারতম্য নিয়ে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমানও। বার্ন ইনস্টিটিউটে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আইএসপিআরের তথ্যে লুবানা হাসপাতাল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই হাসপাতালের তথ্য সম্পর্কে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের রেজিস্ট্রিতে কোথাও মৃত্যু নেই। কিন্তু তারা মুখে বলছে, দুজনকে মৃত অবস্থায় তাদের অভিভাবকেরা নিয়ে এসেছিলেন। ওই দুজনের নাম পরে কোনো হাসপাতালে আসেনি।
সায়েদুর রহমান আরও বলেন, ‘এ ছাড়া একটি পার্থক্য হয়েছে, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একজনের মরদেহ সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই সংখ্যা নিয়ে আমাদের সঙ্গে তথ্যের পার্থক্য হয়েছে। আমরা বলেছি ১৫ জন। আমরা আসার আগে নিশ্চিত হয়েছি, সিএমএইচে ১৫ জনেরই মরদেহ আছে। যদিও আইএসপিআরের তথ্যে সেখানে ১৬ জন বলা আছে। তথ্যের পার্থক্যগুলো দূর হতে হয়তো একটু সময় লাগবে।’
হতাহতের বিষয়ে জানতে চাইলে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ি শাখার একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, হতাহত শিক্ষার্থী ও নিখোঁজ শিক্ষার্থী আছে কি না, তার তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান। প্রাথমিক তথ্য তাঁরা সংগ্রহও করেছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষগুলো থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য আসায় কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আবার ঘটনার ব্যাপকতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরাও নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে এমন দাবি করতে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শত শত শিক্ষার্থী নিহত ও লাশ গুম করার গুজব ছড়ানো হয়।
নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ও গুজবের প্রভাব দেখা যায় গতকালের বিক্ষোভেও। মাইলস্টোন কলেজে গতকাল শিক্ষার্থীরা যে ছয় দফা দাবি জানান, তার প্রথমটিই ছিল নিহত ব্যক্তিদের সঠিক নাম-পরিচয় প্রকাশ এবং আহত ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ।
সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের কবরস্থানের জন্য মাইলস্টোন স্কুলের কাছের উত্তরা ১২ নম্বরের সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতি রক্ষায় পরবর্তী সময়ে এ কবরস্থান সংরক্ষণ করা হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
বিভিন্ন হাসপাতাল ও উদ্ধারকাজে যুক্ত সূত্রগুলো বলছে, যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের অনেকের শরীর ঝলসে গেছে। কারও কারও অবস্থা এমন হয়েছে যে চেহারা চেনা যাচ্ছে না। এ কারণে ঘটনার পরপরই নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গতকাল সকালে ২০ জনের মরদেহ হস্তান্তরের কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান।
অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক
আইএসপিআরের তালিকা অনুযায়ী এ ঘটনায় মোট আহত হয়েছেন ১৬৫ জন। তাঁদের মধ্যে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ৮, বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪৬, ঢাকা মেডিকেলে ৩, সিএমএইচে ২৮, লুবনা জেনারেল হাসপাতালে ১৩, উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ৬০, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১, ইউনাইটেড হাসপাতালে ২ এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৩ জন চিকিৎসাধীন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আহত ব্যক্তিদের বড়সংখ্যক অগ্নিদগ্ধ রোগী। এর মধ্যে যাঁদের ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে বা আগুনে শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রোগীদের মধ্যে দুজনকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে সেখানে এইচডিইউয়ে থাকা অন্তত ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া ৩০ জনের অবস্থা গুরুতর।
আহতদের চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আহতদের চিকিৎসায় দেশের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা হয়েছে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে যুক্ত করা হয়েছে। আহতদের চিকিৎসায় সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসক আনা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গতকাল প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই হাসপাতালের (জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট) সঙ্গে এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) আছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, হাসপাতাল থেকে তাদের কেস রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। তাদের একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও দুজন নার্স আজ রাতে এসে পৌঁছাবেন।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, আহত ব্যক্তিদের জরুরি চিকিৎসাসহায়তা দিতে চেয়েছে চীন, ভারত ও জাপান। এ মুহূর্তে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য কী ধরনের সহায়তা প্রয়োজন, তা দ্রুত জানাতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে এই তিন দেশ।
এখনো নিখোঁজদের সন্ধান
গতকালও নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজতে দেখা গেছে স্বজনদের। গতকাল সকাল ১০টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মর্গে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে লামিয়া আক্তার সোনিয়া নামের একজনের সন্ধান করছিলেন তাঁর স্বামী আমিনুল ইসলাম জনি। তাঁদের মেয়ে আসমাউল হোসনা জাইরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের মর্গের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আসমাউল হোসনা জাইরাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন লামিয়া। তখনই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। জাইরাকে অক্ষত পাওয়া গেছে। কিন্তু গত সোমবার থেকে লামিয়ার কোনো খোঁজ নেই। উত্তরার সব কটি হাসপাতালে খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি। বার্ন ইনস্টিটিউটেও নেই। ছেলেকে কী জবাব দেব, জানি না।’
গত সোমবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে হতাহতের ঘটনায় গতকাল রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়।